প্রবন্ধ-নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত

।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

 

নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
– শিলাবৃষ্টি

 

 

ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল “
– কবি অন্নদাশংকর রায়

ভূমিকা :~
বাংলা কাব্য জগতে – হাতে অগ্নিবীণা, ও রণতূর্য, মুখের বাঁশের বাঁশরী আর রোমান্টিক কবিমন নিয়ে ধূমকেতুর মতই কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। তাঁর কবিতা ও গানে একই সঙ্গে বিদ্রোহের, পৌরুষের ও যৌবনের বেদনার ভাষা বানীরূপ লাভ করেছে । রবীন্দ্রোত্তর – কাব্যজগতে নজরুল রবিতাপে কিন্তু হারিয়ে যাননি ; বরং রবীন্দ্র মায়াজাল ভেঙে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে ছিলেন।

জন্ম :~
বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের চব্বিশে মে (বাংলা ১১ই জ্যেষ্ঠ) অতি দরিদ্র এক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতা – কাজী ফকির আহমেদ, মাতা – জাহেদা খাতুন। বাল্যনাম – দুখুমিঞা। দারিদ্র্যতার কারণে শৈশব থেকেই জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নজরুল।

প্রতিভার প্রেরণা :~
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁরও সৈনিক জীবনের সমাপ্তি ঘটল। দেশে ফিরলেন অনেক রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে। বুকে ছিল পরাধীনতার দুঃসহ বেদনা। রচনা করলেন “রিক্তের বেদন”। আবির্ভূত হলেন – বাংলার কাব্যাকাশে। তিনি বিদ্রোহের কবি, বৈভবের কবি।

গজল :~
সঙ্গীতের প্রতি নজরুলের অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই। কবিতা রচনার সাথে সাথে তিনি রচনা করেছেন সঙ্গীত, করেছেন সুর সংগ্রহ। অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর। যেহেতু প্রবন্ধের বিষয় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত, সেহেতু গজলের প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।
বাংলা গজল গানে নজরুল সার্থক স্রষ্টা। পারস্যের প্রেম সঙ্গীত রূপায়নের জন্যই গজলের জন্ম। গজলের দুটি অংশ –
১) অস্থায়ী এবং ২) অন্তরা। অস্থায়ী অংশ সুর ও তাল সহযোগে গাওয়া হয়, অন্তরা তাল ছাড়া, এই অংশকে বলা হয় – শের বা শেয়র। গজল গানে নজরুল নানারকম রাগ রাগিনী এনেছেন। মূল কাঠামো ঠিক রেখে তিনি – ঠুংরী ও দাদরার আঙ্গিকে বেশ কিছু গজল রচনা করেছেন। এরকম কয়েকটি গান – “উচাটন মন ঘরে রয়না”, “আধো আধো বোল লাজে”।
আবার বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রনে নতুন ধারার গজল সৃষ্টিতে তিনি অতুলনীয়।
বাগেশ্রী এবং পিলু রাগের মিশ্রনে তিনি সৃষ্টি করলেন –
“চেয়োনা সুনয়না ” দুটি বিপরীতমূখী রাগ এই গানে একাত্ম হয়ে গেছে। “আমার যাবার সময় হল”,”পাষানের ভাঙলে ঘুম “- অসামান্য দুটি গজল। নজরুলের গজলের কয়েকটি বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয়। যেমন – তাঁর হাতে –
১) বিদেশী শব্দগুলো একেবারে “বাঙালি” হয়েগেছে।
২) আরবী, ফার্সী শব্দ ব্যাপক ভাবে প্রয়োগ করেছেন।
৩) বাংলা সঙ্গীতে নজরুলের গজল একটি বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আগে বিত্তশালী এবং মুটে মজুরের গানের যে সীমারেখা ছিল – নজরুলের গজল যেন একটি যাদুকাঠিতে সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। “বাগিচায় বুলবুলি তুই” বা “কে বিদেশী, মন উদাসী” গজল গুলি জাত বেজাতের সীমা লঙ্ঘন করল। তাঁরই একটি গানে বলব – “পাষানের ভাঙালে ঘুম, কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়? ” ।

শ্যামাসঙ্গীত :~
ভক্তিগীতি রচনায় নজরুল
যে অসাধারনত্ব এনেছেন – তা তাঁর আগে কারোরই বোধহয় সম্ভব হয়নি। তাঁর ভক্তি গীতির সংখ্যা – কৃষ্ণ, শ্যামা ও ইসলামী মিলিয়ে প্রায় ৭-৫০। এই গানগুলি এক অপূর্ব আলোয় ঝলমল করছে।
যে তিনটি শ্যামাসঙ্গীত প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে – সেগুলি – শ্মশানে জাগিছে শ্যামা ,বলরে জবা বল, কালো মেয়ের পায়ের তলায়।

শ্মশানে জাগিছে > কৌশিক / ত্রিতালে রচিত। আশাবরী ঠাট, মালকোশের প্রভাবে – অপূর্ব এটি একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ কালীস্তোত্র। শ্মশান কালীর এই রূপ আর কোথাও পাওয়া যার না।

বলরে জবা বল -> গানটি ভাষার সারল্যে কাব্য সৌন্দর্যে বাঙালীর হৃদয় হরণ করেছে।

কালো মেয়ের পায়ের তলায় -> গানটি মিশ্র আশাবরী রাগে দাদরায় নিবদ্ধ। অসাধারণ সুর সংযোজনায় গানটি অতুলনীয়।।

এছাড়াও বেহাগ খাম্বাজ / দাদরায় – বক্ষে ধরেন শীব যে চরণ ;
দেশ খাম্বাজ / দাদরায় – আমার মুক্তি নিয়ে কী হবে মা, তুই লুকাবি কোথায় কালী।
নজরুলের এই সুরের সাম্রাজের বিশালতা শুধু অনুভব করতে হয়।

উপসংহার :~
বঙ্গ সংস্কৃতির এক গৌরবময় সম্পদ নজরুলের গজল ও শ্যামাসঙ্গীত সহ সমস্ত গান। নজরুল গীতি যেন – অমৃত সুরসুধায় সিক্ত এক অপূর্ব আস্বাদন সামগ্রী। তিনি বলেগেছেন – “গান আমার আত্মার উপলব্ধি”।

Loading

Leave A Comment